বই বাঁধাইয়ের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, মানুষের চামড়া ব্যবহার করে বেশ কিছু বই একসময়ে বাঁধানো হয়েছে। এই কর্মটির একটি গালভারী নামও রয়েছে— ‘অ্যান্থ্রোপোডার্মিক বিবলিওপেজি’।

২০১৯ সালের একটি হিসেব বলছে, বিশ্বের বিভিন্ন গ্রন্থাগারে ছড়িয়ে রয়েছে এমন বই। ‘অ্যান্থ্রোপোডার্মিক বুক প্রোজেক্ট’ নামের সেই সমীক্ষা জানাচ্ছে, বিভিন্ন গ্রন্থাগারেরর ৫০টি বইকে সন্দেহ করা হয় মানুষের চামড়ায় বাঁধানো বলে। তার মধ্যে ৩১টি সম্পর্কে সন্দেহ ঘনীভূত হয়। বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরে এগুলির মধ্যে ১৮টিকে বিশেষজ্ঞরা নিশ্চিত ভাবে মানুষের চামড়ায় বাঁধানো বলে চিহ্নিত করেছেন।

ইংরেজ গ্রন্থ বিশেষজ্ঞ এডওয়ার্ড ব্রুক-হিচিং তাঁর ‘দ্য ম্যাডম্যান’স লাইব্রেরি’ গ্রন্থে এই প্রসঙ্গে মুখ খুলতে গিয়ে প্রথমেই যে প্রশ্নটি তুলেছেন তা হল, এত কিছুর চামড়া থাকতে কেন মানুষের চামড়া দরকার পড়ল এই সব বইয়ের বাঁধাইকর্মে? আরও বিস্ময়ের ব্যাপার, এই সব বাঁধাইকর্ম কিন্তু সংঘটিত হয়েছিল ১৮ এবং ১৯ শতকের ইউরোপে। অর্থাৎ ‘জ্ঞানদীপ্তি’র যে সময়ে যুক্তিবাদের প্রবল বন্যা এসে ভাসিয়ে দিচ্ছে যাবতীয় কুসংস্কার আর উদ্ভট প্রথা, সেই সময়েই মানুষের চামড়া দিয়ে বাঁধানো হয়েছিল এইসব বই।

ব্রুক-হিচিং জানাচ্ছেন, ইউরোপ এবং আমেরিকায় সেই সময়ে মানুষের চামড়া দিয়ে বাঁধানো হতে থাকে প্রধানত দু’ধরনের বই। এক, বিভিন্ন অপরাধের ‘কেস স্টাডি’ এবং দুই, চিকিৎসাবিদ্যা সংক্রান্ত বইপত্র।

১৭৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লবের সময় গুজব রটে যে, প্যারিসের উপকণ্ঠে মিউডন শহরে মানুষের চামড়কে বই বাঁধানোর উপযোগী করে তোলার জন্য এক ট্যানারি বানানো হয়েছে। সম্ভবত বিপ্লবের ভয়াবহতা থেকেই এমন গুজবের জন্ম হয়েছিল। (সঙ্গের ছবিটি ফরাসি বিপ্লবের সময়ে বাস্তিল কারা-দুর্গের পতনের)

এই মুহূর্তে বিশ্বে মানুষের চামড়ায় বাঁধানো যে ক’টি বইয়ের সন্ধান পাওয়া গেছে, তার মধ্যে অন্যতম ইংল্যান্ডের ব্রিস্টলের প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত খুনের আসামি জন হরউডের চামড়ায় বাঁধানো একটি বই। এই বইয়ে বর্ণিত হয়েছিল হরউডের অপরাধ, বিচার এবং মৃত্যুদণ্ডের বর্ণনা।

ছবিতে প্রদর্শিত বইটি কুমারীত্ব সংক্রান্ত চিকিৎসা বিদ্যার। বইটির বাঁধাইয়ে ব্যবহৃত হয় এক নারীর ত্বক। কাজটি সম্পন্ন হয় লুডোভিক বউল্যান্ড নামে এক চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে

১৭ শতকে লেখা একটি বই কুমারীত্ব সংক্রান্ত চিকিৎসা বিদ্যার। এই বইয়ে আলোচিত হয়েছিল গর্ভধারণ, সন্তানজন্ম সংক্রান্ত বিষয়ও। ১৯৬৫ সালে বইটিকে নতুন করে বাঁধানো হয়। এ বার বইটির বাঁধাইয়ে ব্যবহৃত হয় এক নারীর ত্বক। কাজটি সম্পন্ন হয় লুডোভিক বউল্যান্ড নামে এক চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে।

১৮২৮ সালে স্কটল্যান্ডের এডিনবরায় ১৬টি ধারাবাহিক হত্যাকাণ্ড ঘটে। তদন্ত ধরা পড়ে, এই খুনগুলি করেছিলেন উইলিয়াম বার্ক এবং উইলিয়াম হেয়ার নামের দুই ব্যক্তি। তাঁরা মৃতদেহগুলি রবার্ট নক্স নামের এক শরীরবিদ্যা বিশেষজ্ঞকে বিক্রি করেন। নক্স সেগুলি তাঁর পরীক্ষায় ব্যবহার করতেন।

১৮২৯ সালে বার্কের ফাঁসি হয়। তাঁর চামড়া দিয়ে একটি বই বাঁধানো হয়। বার্কের ‘ডেথ মাস্ক’ এবং সেই বই রক্ষিত আছে এডিনবরার সার্জন’স হল মিউজিয়ামে।

এই বইটির নাম ‘ডি হিউম্যানি কর্পোরিস ফ্যাব্রিকা’। এর একটি কপি মানুষের চামড়া দিয়ে বাঁধান হোসে শাভায়ে নামে এক বাঁধাইকর। কথিত, শাভায়ে নাকি সারা জীবনে মানব-ত্বক ব্যবহার করে চারটি বই বাঁধিয়েছিলেন

১৮৬৩ সালে বাঁধানো এক বইয়ের নাম ‘ডি হিউম্যানি কর্পোরিস ফ্যাব্রিকা’। এর লেখক আন্দ্রে ভেসালিয়াস নামে ১৬ শতকের এক চিকিৎসক। তাঁকে আধুনিক শরীরবিদ্যা চর্চার জনক হিসেবে গণ্য করা হয়। সেই গ্রন্থের একটি কপি মানুষের চামড়া দিয়ে বাঁধান হোসে শাভায়ে নামে এক বাঁধাইকর। কথিত, শাভায়ে নাকি সারা জীবনে মানব-ত্বক ব্যবহার করে চারটি বই বাঁধিয়েছিলেন।

১৯০৩ সালে নিউ ইয়র্কের গ্রোলিয়ের ক্লাবে বই বাঁধাই সংক্রান্ত এক প্রদর্শনী আয়োজিত হয়। তার একটি অংশে রাখা হয় উদ্ভট কিছু বই। সেখানে জার্মান চিত্রকর হোলবাইনের বিখ্যাত ছাপাই ছবির সিরিজ ‘ডান্স অব ডেথ’-এর একটি সংকলন গ্রন্থ। ১৯ শতকে বাঁধানো এই বইটিতেও ব্যবহৃত হয়েছিল মানুষের চামড়া।

শিকাগোর নিউবেরি লাইব্রেরিতে ১৮৪৮ সালের একটি আরবি পাণ্ডুলিপি রক্ষিত আছে। তার সঙ্গে একটি ‘নোট’ পাওয়া গিয়েছিল যাতে বলা ছিল যে, পাণ্ডুলিপিটি মানুষের চামড়ায় বাঁধানো। এই পাণ্ডুলিপিটির কথা আমেরিকান লেখক অড্রে নিফেনেগ্‌গার তাঁর জনপ্রিয় উপন্যাস ‘দ্য টাইম ট্রাভেলার্স ওয়াইফ’ (২০০৩)-এ উল্লেখ করেছেন। প্রসঙ্গত, এই উপন্যাসের পটভূমিকা নিউবেরি।

হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগ্রহে তিনটি এমন বই রয়েছে বলে জনশ্রুতি ছিল। পরে বিশেষজ্ঞরা সেগুলিকে পরীক্ষা করে দেখতে পান, তার মধ্যে দু’টি ভেড়ার চামড়ায় বাঁধানো। আর একটি বই লুডোভিক বাউল্যান্ডের বাঁধানো সেই কুমারীত্ব সংক্রান্ত গ্রন্থ।

মানবত্বকে বাঁধানো বই তাদের ছায়া ফেলেছে সাহিত্য-সংস্কৃতির জগতেও। আমেরিকান সাহিত্যিক এইচপি লাভক্যাফটের (১৮৯০-১৯৩৭) ‘দ্য হাউন্ড’ গল্পে এক কবর-চোরের সংগ্রহে থাকা এমন একটি বইয়ের উল্লেখ আছে।

লাভক্র্যাফটের গল্পে সেই চোর দাবি করছে, সে মানুষের চামড়ায় বাঁধানো একটি পোর্টফোলিও হস্তগত করেছিল যেখানে বেশ কিছু উদ্ভট ছবি ছিল। চোরের দাবি, সেই ছবিগুলি নাকি স্পেনীয় চিত্রকর ফ্রান্সেস্কো গোইয়ার (১৭৪৬-১৮২৮) আঁকা। কিন্তু গোইয়া কখনওই তা স্বীকার করেননি। প্রসঙ্গত, তথাকথিত ভয়ের ছবি আঁকার জন্য গোইয়ার খ্যাতি ছিল।

আমেরিকান হরর ছায়াছবি ফ্র্যাঞ্চাইজি ‘ইভিল ডেড’-এ বেশ কয়েক বার ব্যবহৃত উত্থাপিত হয়েছে ‘নেক্রোনমিকন এক্স-মর্টিস’ নামের একটি বইয়ের প্রসঙ্গ। সেই বই যে শুধু মানবত্বকে বাঁধানো তা-ই নয়। তা নাকি মানব রক্তে লিখিত। প্রসঙ্গত, ‘নেক্রোনমিকন’ লাভক্র্যাফটের বিভিন্ন রচনায় উল্লিখিত একটি কল্পিত বই, যা নাকি সুমেরিয়ার এক কালো-জাদুকরের লেখা।

এখন সময়/শামুমো